কেমন আছেন?

মানসিক স্বাস্থ্য এবং আমরা

আজকে থেকে ৫০ বছর আগেও মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে বিশ্বে তেমন একটা সচেতনতা লক্ষ করা যায়নি। কিন্তু একবিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে আলোচিত বিষয়গুলোর মাঝে মানসিক সুস্থতা অন্যতম। বিষন্নতা, দুশ্চিন্তা, মন খারাপ নিয়ে আমরা যেমন কথা বলি, তেমনি আড়ালে নেই ম্যানিয়া, সিজোফ্রেনিয়ার মত বড় রোগগুলোও।কিন্তু আসলেই কি আমরা সবাই আমাদের মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে সচেতন?

 

২০১৮-১৯ মানসিক স্বাস্থ্য জরিপে দেখা গেছে, বাংলাদেশের প্রাপ্তবয়স্কদের মাঝে প্রায় ১৭% মানুষের মানসিক রোগ বিদ্যমান ;অর্থাৎ দেশের জনসংখ্যা প্রায় ২ কোটি মানুষই মানসিক সমস্যার মোকাবেলা করে যাচ্ছে!দেশে ১০০ জনে প্রায় ৭ জন বিষন্নতায় আক্রান্ত! অবাক বিষয় হল, এর ৯২%-ই চিকিৎসা আওতার বাইরে! এই সমস্যায় শিশুরাও কম আক্রান্ত নয়। দেশের ১৩.৬% শিশু কোন না কোন মানসিক সমস্যায় ভুগছে, যার মাঝে আশংকাজনক ভাবে বাড়ছে দুশ্চিন্তাজনিত মানসিক রোগ; এদের মাঝে চিকিৎসা পাচ্ছে না ৯৪% শিশুই! শিশু- কিশোরের মানসিক রোগের নানা কারণ থাকলেও,মূল কারণ আমাদের অবজ্ঞা ; আমাদের জানাই নেই বাচ্চাদের রোগের উপসর্গগুলো কেমন হয় বা অতিরিক্ত চঞ্চলতা বা অবাধ্যতা যে কোন মানসিক রোগ হতে পারে! দ্রুত চিকিৎসা সম্ভব না হলে, শিশুদের মানসিক রোগ প্রভাব ফেলতে পারে বাচ্চার মস্তিস্ক বিকাশের মত দীর্ঘমেয়াদি ক্ষেত্রে!

 

এই জরিপ থেকে স্পষ্টতই বোঝা যায়, আমাদের মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ে যতটুকু সচেতনতা প্রয়োজন, ততটুকু সচেতন আমরা নই। বাস্তবিকই, এখনো সমাজের প্রতিটি স্তরে মানসিক সমস্যাগুলো নিয়ে আমরা ঠাট্টা করি! হাসি-তামাশার মধ্যে আমরা মানুষকে বলি 'সাইকো', 'ম্যানিক', 'পাগল' বা 'স্ক্রু- ঢিলা', 'তার-ছিঁড়া' ! এখনো আমাদের অনেকেই মনে করেন, কবিরাজের কাছে গেলেই মানসিক রোগের চিকিৎসা সম্ভব; বিশ্বাস করেন, একটু ঘুরে আসলেই বিষণ্নতা ভালো হয়ে যায়; ভাবেন, মানসিক রোগ বলতে আসলে কিছুই নেই, সব ঢং!! কেউ মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞের কাছে পরামর্শ নিতে গেলে, তাকে বিদ্রুপ করতে আমরা ছাড়ি না! আমাদের ধারণা, মেডিকেলের পিছিয়ে যাওয়া মানুষেরাই শুধু সাইকিয়াট্রিস্ট হয়! আমরা শুধু একথাগুলোর নিজেরা বিশ্বাস করি তাই নয়, বরং এই বিশ্বাস ছড়িয়ে দেয়ার চেষ্টা করি আশপাশের সবার মাঝে, আপনজনদের মাঝে! গবেষণা বলে, নারীদের মাঝে মানসিক রোগ হওয়ার প্রবণতা পুরুষের থেকে বেশি, কিন্তু ভ্রান্ত ধারণা সংখ্যা পুরুষদের মাঝে বেশি। পুরুষ সমাজ বিষয়ে আমাদের কিছু স্টেরিওটাইপ কাজ করে, যেমন পুরুষের মনের ভাব প্রকাশ করা উচিত না, পুরুষদের কাঁদা উচিত না, তাদের সব সময় শক্ত থাকা উচিত! সমাজের এই বিশ্বাসের কারণে পুরুষদের মানসিক রোগের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। নারীদের মাঝে ভ্রান্ত ধারণা পুরুষদের থেকে কম হলেও, চিকিৎসা নেয়ার হারও কম, এবং সুস্থ হওয়ার আত্মবিশ্বাসও কম। সমাজের নারীদের উপর প্রথাগত চাপ ছাড়াও, অনেকসময় নারী নিজেও দায়ী তার চিকিৎসা বঞ্চিত হওয়ার জন্য।

 

মানসিক রোগের কি আসলেই চিকিৎসা আছে? উত্তর হচ্ছে -অধিকাংশ মানসিক রোগই চিকিৎসাযোগ্য, এবং সম্পূর্ণ ভালো হয়ে যায়! কিছু রোগ ওষুধে নিয়ন্ত্রনে থাকে, খুবই অল্প সংখ্যক রোগী আছেন যারা সম্পূর্ণভাবে সুস্থতা লাভ করেন না। এবং অধিকাংশ মানসিক রোগের ওষুধের নেশা হয়ে যায় না! একবার ওষুধ খাওয়া শুরু করলে সারাজীবন খেয়ে যেতে হবে- এই ধারণাটিও মিথ্যা! আমাদের বিপরীত ধারণাগুলো মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ে অজ্ঞতা প্রকাশ করে!

 

 

যদি প্রশ্ন করা হয়, আমাদের সমাজে কি দিনদিন মানসিক রোগ বাড়ছে, নাকি সচেতনতার কারণে ডায়াগনোসিস বেশি হচ্ছে? ২০০৩-০৫ স্বাস্থ্য জরিপের সাথে তুলনা করলেই বোঝা যায়, আসলেই দেশে মানসিক রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। মানসিক স্বাস্থ্যের অবনতির জন্য দায়ী করা যায় আমাদের নিজস্ব প্রতিযোগিতামূলক মনোভাবকে, সমাজের চাপ, পরিবেশের অবনতি, প্রত্যাশার চাপবৃদ্ধিকে। একেক জনের ক্ষেত্রে কারণ একেক রকম হলেও, মানসিক স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটছে সার্বজনীনভাবে। পল্লী এলাকার চাইতে নগরে মানসিক রোগীর সংখ্যা যেমন বেশি, তেমনি বেশি চিকিৎসা গ্রহণের হারও।এর পিছনে মূলত দায়ী করা যায় - নগরায়নের চাপ, আমাদের শহরের অত্যন্ত প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশ ও মানসিকতার অসামাঞ্জস্যতাকে।

 

মানসিক রোগ যে মানসিক চাপ ছাড়াও হতে পারে, হঠাৎ করেও হতে পারে, যেকোন বয়সেই হতে পারে, বংশে মানসিক সমস্যা থাকলে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকলেও, বংশে না থাকলেও যে হতে পারে, একজন ধার্মিক ব্যক্তিরও যে হতে পারে- তা আমাদের অনেকেরই জানা নাই। ঠিক একই ভাবে জানা নেই যে- জ্বর - ঠান্ডা -কাশির মত মানসিক রোগও অসুস্থতা, যার চিকিৎসা নেয়ায় লজ্জার কিছুই নেই! আশার খবর হলো, উচ্চ-মধ্য-নিম্নবিত্ত সকল শ্রেণী মানুষেরই মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ে সচেতনতা দিনদিন বাড়ছে। অনেকেই চিকিৎসা নেয়ার কথা ভাবছেন, নিতে চাচ্ছেন, এমনকি নিচ্ছেনও। যদিও চিকিৎসকের শরণাপন্ন হচ্ছেন এমন ব্যক্তির সংখ্যা এখনো অনেক কম, কিন্তু স্রোতের বিপরীতে এসে যারা বৈজ্ঞানিক চিকিৎসা নিচ্ছেন, দিনশেষে তারাই লাভবান হচ্ছেন। একারনেই হয়তো, গবেষনায় দেখা যায়, তথাকথিত চিকিৎসার চাইতে মানুষের আস্থা দিন দিন বাড়ছে বৈজ্ঞানিক চিকিৎসায়।

 

 

বাংলাদেশের জনগণের মানসিক সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করতে যে পদক্ষেপগুলো নেওয়া সম্ভব তা হল- **শহর-গ্রাম সব পর্যায়ে, নারী-পুরুষ সকলের মাঝে, সমাজ থেকে শুরু করে পরিবারের প্রতিটি সদস্যগণের মাঝে মানসিক সুস্থতা বিষয়ক সচেতনতা বাড়ানো।এতে দেশের মিডিয়া, সোশ্যাল মিডিয়া এবং রাষ্ট্রের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সাহায্য নেয়া। ** এমবিবিএস কারিকুলামে সাইকিয়াট্রি অংশের উপর গুরুত্ব প্রদান ** মাঠ পর্যায়ে মানসিক স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করণ ** মানসিক সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করতে, আধুনিক কর্মকৌশল অবলম্বন করা **রোগের চিকিৎসায় সকল বিভাগের চিকিৎসকদের জ্ঞানকে যুক্ত করা; কারণ শারীরিক ও মানসিক রোগ ওতপ্রোতভাবে জড়িত এবং একটিকে বাদ দিয়ে আরেকটির চিকিৎসা বাস্তবে সম্পূর্ণ কখনোই সম্ভব নয় এসব কিছুর মাঝে কোনটাই রাতারাতি হয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। কিন্তু কার্যক্রম শুরু করতে হবে আজই এবং এখনই! মানসিক রোগের অবহেলার জন্য আরেকটি প্রাণ হারাতে, আরেকটি ভবিষ্যৎ নষ্ট হতে দিতে।

 

 

 

fascinated 0 Readers
informed 0 Readers
happy 0 Readers
sad 0 Readers
angry 0 Readers
amused 0 Readers

Appointment

01763438148